ভালোবাসার সাইক্লিক অর্ডার (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-১)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৬:২৩:৪৭ সন্ধ্যা
[ 'আমি'র সাথে 'তুমি'র হৃদয়ের মিল হবার পরে এক সাথে থাকার কারনে এবং ছোটখাট ভুল বোঝাবুঝির দ্বারা 'সে'র আগমন ঘটে। ভালোবাসা কিংবা ভালোলাগা তখন এই তিন হৃদয়ে 'আমি' > 'তুমি' > 'সে' এভাবে সাইক্লিক অর্ডারে ঘুরে বেড়ায়। এতে করে প্রত্যেকেই সুখী হতে গিয়ে আসলে সুখের ভান করে কেবলি। কিন্তু আদতেই কি কেউ সুখী হয়?
ওরা চারজন। দুজন নারী ও দুজন পুরুষ। দুই পরিবারের অতি সাধারণ নিত্যকার ঘটনা নিয়ে এই কাহিনী এগিয়ে যাবে।আপনার-আমার-আমাদের সবার পরিবারেই এই সব ছোট খাটো দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে মনের অগোচরে ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু তার কতটুকু আমরা উপলব্ধি করছি? সমস্যা যখন সমাধানের পর্যায় পার হয়ে যায়, তখনই আমরা পথের সন্ধানে গোল চক্কর কাটা শুরু করি। এই গল্পে হৃদয় নিয়ে টানাপোড়েন এবং সম্পর্কের ভিতরের সম্পর্ককে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
কারো ব্যক্তিগত জীবনের সাথে মিলে গেলে সেটা কাকতালীয় ব্যাপার ধরে নিলে খুশি হব। কারণ জীবন-দর্শণ এবং যাপন পদ্ধতি আমাদের অনেকেরই প্রায় একই রকম। চলুন তাহলে ভালবাসার সাইক্লিক অর্ডারে ...]
১.
পাভেল গভীর ঘুমে।
রাস্না নেটে। একই বিছানায় থেকেও কত দূরে দুজন। মনের দিক থেকে।
পাভেলের নিজস্ব ব্যবসা রয়েছে।এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টের। সারাদিন এবং রাতের কিছুটা সময় সেই কাজেই ব্যয় করে এখন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। রাস্না ওকে রাতের খাবার সার্ভ করে একজন বউ হিসেবে আর যা যা করনীয় সব করে এই মাত্র ফেসবুকে বসেছে। রাহাতের সাথে চ্যাটে বসেছে। এখন অনেক রাত। দেড়টা বাজে। এই সময়ে একজন বিবাহিতা মহিলা তার স্বামীর সাথে একই বিছানায় বসে অন্য পুরুষের সাথে ইনবক্সে অনুভুতি শেয়ার করছে...
এই যুগলের নিজেদের সম্পর্কটা কতটা ধুসর সেটা এতেই বোঝা যায়।
রাহাত খুব বিরক্ত। এমন একটা এলাকায় রয়েছে, নেটের ফ্রিকোয়েন্সি যাওয়া-আসার উপরে রয়েছে। চ্যাটে বসে এই বিশেষ মুহুর্তে যদি নেট এমন করে তবে মেজাজ তো খারাপ হবারই কথা। রাস্নার ইনবক্সের ম্যাসেজ গুলো পড়ছিল। ওর একটু দুরেই টিভিতে সিরিয়াল দেখছে পিম্পি। সারারাত হিন্দি সিরিয়ালগুলো দেখতে থাকে সে। এরই ফাঁকে ফাঁকে মন চাইলে শরীরের চাহিদা। মনের চাহিদা দুজনের অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন যন্ত্রের মতো চলছে এরা। টিভির সাউন্ডে আরো একটু বিরক্ত হয় রাহাত। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কখনো পিম্পিকে সেটা প্রকাশ করে না। এক মেয়ে ওদের। নিজেদের ভিতর যাই হোক না কেন, কখনো সেটা ওদের রুমের বাহিরে যায় না। বাচ্চার কানেও পৌঁছায় না।
রাহাত কিচেনে চলে গেল। কফির পানি গরম করতে। পিম্পি একবার তাকিয়ে রিমোট হাতে নেয়। টিভি অফ করে কিচেনে আসে। কোনো কথা না বলে রাহাতের হাত থেকে পানির পাত্র নিয়ে নেয়। নিজে কফি বানাবে বলে ওকে চলে যেতে বলে।
রাহাত ফিরে আসে।
ফিরে আসে রাস্নার ইনবক্সে।
চ্যাটে রাস্না ও রাহাতঃ
: তুমি তোমার বিছানায় পিঠে বালিশ দিয়ে বসে আছ। আমি একটা চিরুনি নিয়ে তোমার চুলগুলি আচড়ে দিচ্ছি... তোমার এক পাশে বসে। তোমার বালিশে হেলান দিয়ে আমিও বসে আছি।
তোমার চুলগুলি খুবই সুন্দর!
: হাহ হা হা
: আজ তোমার সাথে একটু অন্য ধরণের প্রেম হবে। সামথিং ডিফারেন্ট...
: মানে?
: আজ হবে নান্দনিক প্রেম।
: এটা অনেক কষ্টের... এর থেকে ত র'...
: ভালো হবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি।
: ওকে বাবা। এই চুপ করলাম।
: ভাল ছেলে!... আমি তোমার চোখগুলো ভাল করে দেখলাম। শান্ত... স্নিগ্ধ... তোমার কথাগুলোকে মনে হল বাতাস... আমার চুল এলোমেলো করে দিয়ে কোথায় উড়ে যাচ্ছে। একটু বসে ভাবি। তুমিও ভাবতে থাকো। জীবন খুব সুন্দর! কত কাছাকাছি আছি আমরা... ভাল লাগার অসহ্য সুখ নিয়ে! মুহুর্তটা চলে যাচ্ছে দ্রুত। জীবনে সময় এতো কম!!তবুও জীবন তো। তোমার কাধে মাথা রেখে বসে রইলাম।তোমার হাতে একটা বই... রবীন্দ্রনাথ... গল্পগুচ্ছ। তুমি পড়ছ, আমি পাশে আছি... যতক্ষণ থাকা যায়।
আধা ঘন্টা পর...
রাস্না পাভেলের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু কি মায়া করে উঠল বুকের কোনো এক যায়গায়? এখনো কি এই ফিলিংটার কিছু অবশিষ্ট আছে ওদের মাঝে? মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে ইচ্ছে হল। কিন্তু কঠিন ভাবে ইচ্ছার গলাটিপে ওর পাশে একটু দুরত্ত রেখে শুয়ে পড়ল সে। এতো কাছে - কিন্ত লক্ষ যোজন দুরত্ত ওদের ভিতর। সেই দুরত্তের মাঝে থেকে রাহাত নামের একজন বিচরণ করতে থাকে রাস্নার স্বপ্নলোকে!
…
পিম্পি একটি কেজি স্কুলের সিনিয়র টিচার। একমাত্র মেয়েকে সাথে নিয়েই সকাল ৮ টার ভিতরে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।রাহাতের অফিস ৮টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অফিসার সে। বাসা ভার্সিটির সাথে হওয়াতে একেবারে মুখে মুখে ঘুম থেকে উঠে। অনেক রাত পর্যন্ত নেট ব্যবহার করে। ঘুমাতে ঘুমাতে সেই রাত আড়াইটা -তিনটা বেজে যায়। পিম্পি অনেক ভোরে উঠে নাস্তা বানিয়ে রুহিকে খাওয়ায়, রাহাতের জন্য টেবিলে সাজিয়ে রাখে। ওর অফিসের পোশাক, টাই এমনকি জুতোর মুজা জোড়াও সামনে রেখে দেয়।
একেবারে বাবুদের মতো। আনমনে হেসে ফেলে। একটু শব্দও হয়। রিক্সায় ওর পাশে বসা মেয়ে রুহি মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ' আম্মু, হাসো কেন?'
পিম্পি মেয়ের দিকে তাকায়। বলে, ' এমনিতেই বাবু।' মেয়ের মাথার চুলগুলো নেড়ে দেয় একটু। রিক্সা ওদেরকে নিয়ে সামনের দিকে আগায়।
পিম্পির কাছে রাহাত একটা ছোট বাবুর মতই... ছিল... একসময়।
এখন কি নেই?
একটা গভীর দীর্ঘশাস ফেলে পিছনের কথা চিন্তা করে সে। রুহিকে পৃথিবীতে এনেছে তারা অনেক দেরীতে। পিম্পির অনেক ইচ্ছে ছিল। কিন্তু রাহাত 'একটু গুছিয়ে নেই' - 'একটু দাঁড়িয়ে নেই আগে' বলে বলে ওকে অনেক অপেক্ষা করিয়েছে। ১৪ বছরের সংসারে রুহিকে এনেছে আজ ৬ বছর হল। ওর সাথের বান্ধবীদের তিন চারটা করে ছেলে মেয়ে।
কিন্তু সেটা কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা শুরু হয়েছে আজ ৬ মাস হল। খুব ভালই কেটে যাচ্ছিল জীবন। রাহাতের জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটির এই জবটা হবার পরে ওরা চিটাগং থেকে প্রথমে ক্যাম্পাসের অ্যালটেড বাসায় উঠে আসে। পরে ভার্সিটির পাশের এলাকায় ভাড়া বাসায় চলে যায়। সেখানেই আছে এখনো। দুজনের দিনগুলো কাটছিল স্বপ্নের মত।
রুহি-রাহাত আর সে... সুখী একটা পরিবার। প্রতিদিন বিকেলে রাহাতের বাইকের পিছনে বসে তিনজনের ক্যাম্পাস পরিভ্রমণ অনেকেরই চোখে লাগতো... হিংসেও হতো কারো কারো। এক একদিন ওরা দূরে চলে যেত। রাহাত খুব পাকা ড্রাইভার। এ পর্যন্ত পিম্পিকে নিয়ে সে অনেক ড্রাইভ করেছে। কখনো সমস্যা হয় নাই। কিন্তু রাস্নারা ওদের পাশের ফ্ল্যাটে আসার পর থেকেই সমস্যা শুরু হল।
ওর সেই পাকা ড্রাইভার এখন অন্য একজনকে সাথে নিয়ে ড্রাইভ করা শুরু করেছে। সব কিছু খুব দ্রুতই হয়ে যাচ্ছে।
ওর চোখের সামনে... সে সব দেখেও ছাড় দিয়েছে।
দেখছে কতদুর ওরা যেতে পারে।
ওদের ভালবাসার বিয়ে। পরিবারের সকলের অমতে রাহাতকে নিয়ে আলাদা সংসার গড়েছে। এখন এটা ওর নিজের সমস্যা। সে একাই সামলাবে। তবে ওর আর রাহাতের ভিতর ঠিক কি কারণে এবং কোথায় ছন্দপতন হল সেটিই ভেবে বের করার চেষ্টা করছে। ভালবাসায় তো ওর কোনো খাদ ছিল না। তবে আজ কেন এই খেদ? এ জন্যই রাতের পর রাত রাহাত আর রাস্না যে নেটে প্রেম করে চলেছে, সেটা জানার পরেও সে কখনো প্রশ্নের আঙ্গুল তুলে নি। আগে নিজের কাছে সে ক্লিয়ার হবে- কেন এই দুরত্ত। ভালবাসার কোন সুরটাকে সে হারিয়ে ফেলেছে- যে তালটা কেটে গেছে আগে সেটাকে ফাইন্ড আউট করা প্রয়োজন। তারপরেই সেটা যদি জোড়া দেয়া যায় চেষ্টা করবে। নচেৎ...
নচেৎ কি?
রিক্সাটা স্কুলের সামনে এসে দাঁড়ায়। পিম্পির চিন্তার স্রোত কুলে এসে ভিড়ে। ক'জন গার্জিয়ানের হাসির প্রতি উত্তর হাসি দিয়েই দেয়। ভাড়াটা বের করে রিক্সাওয়ালাকে দিয়ে মেয়ের হাত শক্ত করে ধরে স্কুলের ভিতরে নিয়ে যায়। হৃদয়টাও শক্ত হয়ে যাচ্ছে ওর। সে কোমলে কঠোরে মিশানো একজন মা এবং প্রেমিকা, যার হৃদয়টা যার জন্য ব্যকুল সে এখন অন্য একটা হৃদয়ের পানে ছুটে চলা এক নিহারিকা...
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১০০৫ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
শুভেচ্ছা রইলো।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
ইনশা আল্লাহ, বেশীক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রাখব না।
অনেক শুভেচ্ছা আপনার জন্য।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
অন্য রকম এক আবহ বিরাজ করছে লেখা পড়ে....। শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন আপনাকে।
সময় যদিও কম, তবুও এরই ভিতরে নিখাদ ভালবাসার যতটুকু পারেন, বুঝে নিয়েন।
শুভেচ্ছা অনেক অনেক আপনার জন্য।
ভালো থাকবেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন